একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি, আমি গান করি বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত। জীবনের এপর্যন্ত সময়ে যখনই আমি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গানের গভীরতা কিংবা আমার কেন এতো ভাল লাগে-এসব নিয়ে কোনো আসরে আলাপ করেছি কেউ না কেউ বিদ্রোহী কবি নজরুলকে সামনে এনেছে। ভাল কথা- কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি রবীন্দ্রনাথ হিন্দু পরিবারে আর নজরুল মুসলমান পরিবারে জন্মেছেন বলে তারা নজরুলকে টেনে আনে।

এরা কখনও হয়ত বুঝবেই না কবিরা সব মানুষের কবি। যার যার অবস্হানে স্বতন্ত্র। এরা কখনও জানার চেষ্টা করে না রবীন্দ্নাথ নজরুলকে কত স্নেহ করতেন, নজরুল ও কবিগুরুকে শ্রদ্ধাভরে ‘গুরু’ ডাকতেন। এরা জানেনা “ বিদ্রোহী” কবিতা লেখার জন্য নজরুল জেলে গেলে একমাত্র রবীন্দ্রনাথই নিজের অর্থ ব্যয় করে নজরুলকে জেল থেকে ছাডিয়ে আনেন। এরা জানলে হয়তঃ প্রথম প্রথম বিশ্বাসই করবে না যে নজরুল ইসলামী গান/গজলের পাশাপাশি প্রচুর শ্যামাসংগীত লিখেছেন।

এরা রবীন্দ্রনাথ যে তাদের অর্থাৎ আমাদের জাতের তা বোধ হয় মানবেই না। এদের ভাবনার সিলেবাসে বাঙালী রবীন্দ্রনাথ যে বাংলাদেশ নয় শুধু, বহু ভাষাভাষি বিরাট দেশ ভারতের ও জাতীয় সংগীতের রচয়িতা সুরকার – তা ঢুকবে না।

নজরুল কিংবা লালন যে কত বড় অসাম্প্রদায়কি চেতনার কিংবদন্তী তা এদের মগজে নাই। এদের প্রায় প্রত্যেকেরই শিক্ষাজীবনে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী শিক্ষক রয়েছেন যাদের পাঠদানের প্রশংসায় এরা মশগুল থাকে। এদের প্রতিনিয়ত ভারতীয় সংগীত, চলচ্চিত্র ছাড়া চলেই না। আমি এমন ব্যক্তিও পেয়েছি রবীন্দনাথের গান কিংবা মান্না দের কন্ঠের ভূয়সী প্রশংসা করে কিন্তু প্রচন্ড হিন্দুবিদ্বেষী। মাঝে মাঝে খুব হতাশ হয়ে যাই। আমি দেখেছি সব সময় আওয়ামীলীগ আর হিন্দু মানুষকে গালাগাল করে কিন্তু নিজের ছেলেদের ভারতেই লেখাপড়া করায়। আমার ক্ষেত্রে আমি আরো প্রত্যক্ষ করেছি এরা ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করাতে অধিকতর আগ্রহী। আর ইদানীং কালে ভারতীয় সিরিয়াল ও এদের প্রিয় হয়ে উঠেছে যেখানে পুজা পার্বন বেশী দেখায়।

প্রকৃত ধার্মিকতা আমাদের উদারতার শিক্ষা দেয়। কেননা আমাদের পরিস্কার বুঝতে হবে আমরা মুসলমানেরা যেমন আল্লাহ খোদায় বিশ্বাসী। হিন্দুরা তেমন রাম রাবনে বিশ্বাসী হতেই পারেন। কারো বিশ্বাসকে আমরা কেড়ে নিতে পারবো না। কটাক্ষ করে, বিদ্বেষমূলক কথা বলে, কিংবা ধর্মপালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আপনি কি আপনার ধর্মের কোনো সেবা করতে পারবেন? আমার ইসলাম কিংবা জানামতে কোনো ধর্ম এমন কাজকে সমর্থন করে না। কিন্তু এসব মুখে বললে তো হবে না বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।

এবারের দুর্গা পুজায় মন্ডপে যারা হামলা করেছে, যারা উগ্রতা – বিদ্বেষ ছডিয়ে নাগরিকদের ধর্ম পালনে বিরত রেখেছে, বাধা দিয়েছে, যাদের কারনে বছরের বড় উৎসবটি করতে না পেরে নীরবে সরবে মানুষ কেঁদেছে – এর প্রত্যেকটি ঘটনার যথাযথ তদন্ত করে দোষীদের বিচার ও বিচারের রায় বাস্তবায়ন আগামী দুর্গা পুজার আগেই করার জন্য আমাদের সরকারের প্রতি জোর দাবী জানাই।

সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীতে সবাইকে নিয়ে শান্তিতে বসবাস করাই ইসলামের মূল চেতনার পাঠ। এরূপ চেতনা থেকেই আমাদের দেশে রাজনৈতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের সূত্রপাত দেখি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে। বাঙালির হাজার বছরের শাশ্বত ঐতিহ্য জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সৌহার্দ্য রক্ষা করে চলা- সমাজে বসবাস করা।

কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের আইন বিষয়ক উপকমিটির সদস্য
ব্যারিস্টার- সওগাতুল আনোয়ার খান

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।